
ফার ইস্যুতে আবাসন ব্যবসায় স্থবিরতা
- আপলোড সময় : ২২-০৮-২০২৫ ০২:৫২:২৩ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২২-০৮-২০২৫ ০২:৫২:২৩ অপরাহ্ন


* নতুন নিয়মে ফ্ল্যাট সংখ্যা কমার আশঙ্কা
* এলাকাভিত্তিক ফ্লোর এরিয়া রেশিও
* তলা কমা ও আয়তন বাড়ায় ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে
* আগ্রহ হারাবেন জমির মালিক ও ডেভেলপাররা
* এফএআর নির্ধারণে বৈষম্যের অভিযোগ
স্টাফ রিপোর্টার
রাজউকের নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) কারণে রাজধানীতে থমকে আছে নতুন ভবনের নকশা অনুমোদন। নতুন ড্যাপের নিয়মে সড়কের প্রশস্ততার ওপর ভিত্তি করে ভবনের উচ্চতা ও ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর বা ফার) নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ছোট রাস্তার পাশের জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ প্রায় অসম্ভব বলে জানাচ্ছেন আবাসন সংশ্লিষ্টরা।
নতুন নিয়মের কারণে জমির মালিকরা তাদের জমি ডেভেলপারদের দিতে আগ্রহ হারাবেন। তাদের বক্তব্য, ছোট রাস্তার কারণে ভবনে তলার সংখ্যা কমে গেলে ডেভেলপারদের সঙ্গে লাভজনক শেয়ার চুক্তি করা সম্ভব হবে না। এতে জমির মালিক যেমন প্রাপ্য ফ্ল্যাটের সংখ্যা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ছেন, তেমনি ডেভেলপাররাও বিনিয়োগের ঝুঁকিতে যেতে চাইছেন না।
উদ্যোক্তাদের হিসাব অনুযায়ী, ৩ কাঠার প্লটে জনঘনত্ব ১ দশমিক ৭৭ হলে আগে যেখানে ১২টি ফ্ল্যাট করা যেত, সংশোধিত নিয়মে তা নেমে আসবে ছয়টিতে। ৫ কাঠার প্লটে আগে ১৪১৬টি ফ্ল্যাট পাওয়া যেত, এখন হবে মাত্র ৯টি-এর মধ্যে বড় সাইজের সিঙ্গেল ইউনিট ২৪শ স্কয়ারফুট বা ডাবল ইউনিট ১২শ স্কয়ারফুট। সংশোধিত ড্যাপে ঢাকা শহরকে ৬৫টি জনঘনত্ব ব্লকে ভাগ করে নতুন এফএআর নির্ধারণ করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ এফএআর গুলশান-বনানীতে ৫ দশমিক ৫ এবং সর্বনিম্ন ১ দশমিক ৬। গুলশান-বনানীতে ফার বেড়েছে ১ দশমিক ৭ থেকে ২ দশমিক ০, ধানমন্ডিতে ১ দশমিক ৭ থেকে ২ দশমিক ১, রামপুরায় ১ দশমিক ৪ থেকে ২ দশমিক ৩, খিলক্ষেতে ১ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক কিছু ক্ষেত্রে এলাকাভেদে আরও বেশি। তবে বারিধারায় ফার কমেছে ১ দশমিক ৮ থেকে ১ দশমিক ৭। বসুন্ধরায় ১ দশমিক ৯ থেকে ২ দশমিক ০, মিরপুরে ১ দশমিক ৭ থেকে ২ দশমিক ০।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বসুন্ধরা ও আফতাবনগরের মতো পরিকল্পিত এলাকার মধ্যে অযৌক্তিক বৈষম্য রাখা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বসুন্ধরায় জনঘনত্ব ১ দশমিক ৯৮ আর আফতাবনগরে ১ দশমিক ৫৮, অথচ ঘর-বাড়ির ঘনত্ব ঠিক বিপরীত অনুপাতে। এছাড়া মেইন সিটিতে ১ দশমিক ৯৭, ১ দশমিক ৫৭, ১ দশমিক ৮৭ এর মতো ভিন্ন জনঘনত্ব নির্ধারণ করায় ৫ কাঠার প্লটে ফ্ল্যাট সংখ্যা আরও কমে যাচ্ছে।
উদ্যোক্তাদের মতে, বড় আকারের ফ্ল্যাট বাধ্যতামূলক করার ফলে নির্মাণ খরচ ও বাজারমূল্য উভয়ই বাড়বে। এতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমশ বাইরে চলে যাবে আবাসন বাজার থেকে। ধনী এলাকার (গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি) উচ্চ এফএআর ভবনগুলোকে আরও বড় করবে, তবে মধ্য ও নিম্নবিত্ত এলাকায় ভবন সংখ্যা ও ফ্ল্যাট কমবে। সব মিলিয়ে ড্যাপ সংশোধন কেন্দ্র করে সরকারের নীতিনির্ধারক, প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদ ও আবাসন উদ্যোক্তাদের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। একপক্ষের দাবি, এটি ঢাকার আবাসন সংকট সমাধানের পথে এক ধাপ; অন্যপক্ষের মতে, এতে ফ্ল্যাটের দাম নাগালের বাইরে যাবে এবং শহরের বাসযোগ্যতা আরও হুমকির মুখে পড়বে।
একাধিক রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, ড্যাপের কারণে অনেক নকশা অনুমোদন আটকে আছে। নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু হচ্ছে না, ফলে বাজারে নতুন ফ্ল্যাটের সরবরাহ কমে যাচ্ছে। এ সুযোগে পুরোনো অনুমোদনপ্রাপ্ত ভবনগুলোর ফ্ল্যাট চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।
জমির মালিক ও উদ্যোক্তারা বলছেন, ড্যাপের উদ্দেশ্য ছিল অবৈজ্ঞানিক ও অপরিকল্পিত ভবন নিয়ন্ত্রণ করা এবং জনবসতির চাপকে সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করা। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে, যা সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব।
খাতের সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, ড্যাপ পুরোপুরি কার্যকর না হলে রাজধানীতে ভবন অনুমোদন প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘায়িত হবে। এতে ফ্ল্যাটের সরবরাহ ঘাটতি এবং চাহিদাজনিত মূল্যবৃদ্ধির চাপ চলতেই থাকবে। অন্যদিকে, ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার ফার সংক্রান্ত সমস্যায় কমেছে সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো প্রকল্পের গতি। এ কারণে সংশ্লিষ্ট লিংকেজ প্রায় দুই শতাধিক ইন্ডাস্ট্রিতে মারাত্মক স্থবিরতা বিরাজ করছে। কমেছে উৎপাদন, লোকসান কমাতে বাধ্য হচ্ছেন কর্মী ছাঁটাই করতে। এতে বেকারত্বের হার বাড়বে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনীতি।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ড্যাপ ও ইমারত বিধিমালা সংশোধনের জন্য এখন পর্যন্ত মোট ৩৭টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে ৩টি, সচিব পর্যায়ে ৪টি, মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির ১০টি এবং রাজউকের অংশীজনদের সঙ্গে ২০টি বৈঠক রয়েছে। এসব আলোচনার ভিত্তিতে শিগগির আসতে পারে চূড়ান্ত ঘোষণা।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সভাপতি এবং জাপান গার্ডেন সিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াদিুজ্জামান বলেন, মৌলিক চাহিদার অন্যতম নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করতে চান উদ্যোক্তারা। খাতের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শহরে সুন্দর ও নান্দনিক ভবন তৈরি হয়েছে। আবাসন শিল্পের কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করে রড, সিমেন্টসহ দুই শতাধিক লিংকেজ শিল্প অর্থনীতির চাকা গতিশীল রেখেছে। যেখানে প্রায় দুই কোটি লোক জড়িত আর জিডিপিতে প্রায় ১৫ শতাংশ অবদান রয়েছে এ খাতের। ড্যাপের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই স্থবির হয়ে আছে আবাসন ব্যবসা। এটার সমাধান না হলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ও বেকারত্ব বাড়বে।
ঢাকা সিটি ল্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান সমন্বয়ক প্রফেসর ড. দেওয়ান এম এ সাজ্জাদ ড্যাপ সংশোধন সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের সভায় ঢাকার ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের অ্যাসোসিয়েশনকে পক্ষভুক্ত না করায় তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮-এর আলোকে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০২৫ ঘোষণার দাবি জানান। ড্যাপ সংশোধন-পরিমার্জন না করা হলে তীব্র আন্দোলনের কথা জানান তিনি।
বেসিক বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ বলেন, নতুন ড্যাপ সংশোধনীতে আগের মতোই বৈষম্য রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, বসুন্ধরায় জনঘনত্ব ১ দশমিক ৯৮ ও আফতাবনগরে ১ দশমিক ৫৮, অথচ দুটোই পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। বসুন্ধরায় ঘরবাড়ি বেশি হলেও জনঘনত্ব কমানো হয়নি, আর আফতাবনগরে বাড়ানো হয়নি।
ভূমি মালিক সমিতির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. দেওয়ান এম এ সাজ্জাদ বলেন, ঢাকা শহরের প্রকৃত জমির মালিকরা ভবন নির্মাণ করতে পারছেন না। নতুন করে কোনো ভবন নির্মাণ করতে গেলেই জটিলতা তৈরি হচ্ছে, এ কারণে প্ল্যান পাস হচ্ছে না। একই পরিমাণ জমিতে আগে যেখানে ১০ তলা ভবন হতো, এখন ফার ইস্যুতে পাঁচতলা ভবন পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, ব্যাপক ক্ষতি ও চরম বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হচ্ছে জমির মালিকদের। আমরা মনে করি এর মাধ্যমে প্রকৃত ভূমি মালিকদের ঢাকা শহরের বাইরে বের করে দেওয়ার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা। আমরা ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ ও বৈষম্যমূলক ফার সংশোধনের দাবি জানাই সরকারের কাছে।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি প্রকৌশলী আবু সাঈদ এম আহমেদ ড্যাপ-২০২২-২০৩৫-কে ‘জনবৈরী, বৈষম্যপূর্ণ ও অকার্যকর’ আখ্যা দিয়ে বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। তার মতে, এই পরিকল্পনা পুরোনো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি এবং বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ, যা নির্মাণ খাতকে স্থবির করেছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান মনে করেন, ফার কোথাও কমেনি, বরং বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের চাপেই এই পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা ঢাকার ঘনত্ব ও অবকাঠামোগত চাপ আরও বাড়াবে।
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ